আপনি কি জানেন পৃথিবীতে মশার কামড়ে মানুষের সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়? মশার কামড়ে প্রতিবছর মারা যায় ৭ লাখ ২৫ হাজার। যার মধ্যে অন্যতম একটি রোগ ডেঙ্গু জ্বর। আমরা সবাই জানি, ডেঙ্গু জ্বর মশাবাহিত ভাইরাসজনিত জ্বর। গরম ও বর্ষার মৌসুমে ডেঙ্গু জ্বর প্রকোপ বাড়ে। এই সময় একমাত্র সাবধানতায় পারে আপনাকে রক্ষা করতে পারে। সুতরাং, চলুন আজকে জেনে নিই ডেঙ্গু জ্বর সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যঃ
আরও পড়ুনঃ ব্ল্যাক ফাঙ্গাস কি? এর লক্ষণ ও প্রতিকার।
ডেঙ্গু জ্বর কী এবং যেভাবে ছড়ায়
ডেঙ্গু জ্বরের উৎপত্তি ডেঙ্গু ভাইরাসের মাধ্যমে। এডিস মশার দুইটি প্রজাতি যার মাধ্যমে মূলত ডেঙ্গু ভাইরাসের জীবাণু ছড়ায়। একটি হচ্ছে এডিস ইজিপ্টি এবং আরেকটি অ্যালবোপিকটাস। সাধারণত বেশিরভাগ এডিস ইজিপ্টাই নামক মশার কামড়েই হয়ে থাকে। আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোনো জীবাণুবিহীন এডিস মশা কামড়ালে সেই মশাটি ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশায় পরিণত হয়। সেই জীবাণুবাহী মশা কোনো সুস্থ ব্যক্তিকে কামড় দিলে সেই ব্যক্তি চার থেকে ছয়দিনের ( অবস্থান ভেদে ৩-১৩ দিন) মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়। এভাবে একজনের থেকে আরেকজনে রোগ ছড়াতে থাকে। এডিস মশা শুধু দিনের বেলায় কামড়ায়। ফলে দিনের বেলায়ই এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণসমূহ
ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্তদের প্রথমে বেশি উপসর্গ দেখা যায় না। ডেঙ্গু হলে প্রথমে ডেঙ্গুর সাধারণ কিছু লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকে। সংক্রমণের কোর্স তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত: ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বর, ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর, ডেঙ্গু শক সিনড্রোম।
ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুর লক্ষণগুলো হলঃ
- তীব্র জ্বর ( প্রায়শ ৪০ °সে বা ১০৪°-১০৫° ফারেনহাইট এমনকি তার বেশি) হয়। দুই থেকে সাতদিন স্থায়ী হয়।
- এর সাথে মাথাব্যথা ও চোখের পেছনে ব্যথা হয়। এর সাথে অস্থি, কোমর, পিঠসহ অস্থিসন্ধি এবং মাংসপেশিতে তীব্র ও প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হয়। অনেক সময় ব্যথা এত তীব্র হয় যে, মনে হয় বুঝি হাড় ভেঙে যাচ্ছে। তাই এই জ্বরের আরেক নাম ‘ব্রেক বোন ফিভার’।
- এক পর্যায়ে দেহে ৫০-৮০% উপসর্গে র্যাশ বেরোয়। শরীরজুড়ে লালচে দানা দেখা দেয়।
- ক্লান্তিবোধ, অরুচি ও বমি বমি ভাব দেখা দেয়।
- সাধারণত রোগী চার থেকে পাঁচ দিন পর জ্বর থেকে সুস্থ হয়ে উঠে। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে সুস্থ হওয়ার দুই থেকে তিন দিন পরে আবার জ্বর আসে। একে ‘বাই ফেজিক ফিভার’ বলে।
হেমোরেজিক
- ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর ডেঙ্গুর জটিল অবস্থা। রোগীর অবস্থা চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলে লক্ষণগুলো আরো প্রকট ভাবে প্রকাশ পেতে থাকে। । এসময়ঃ
- তীব্র পেটে ব্যথার সাথে ক্রমাগত বমি হতে থাকে।
- পেটে বা ফুসফুসে পানি জমে শ্বাসকষ্ট হয়।
- চামড়া কিংবা মিউকাস ঝিল্লির নিচে রক্তক্ষরণ অথবা নাক, মুখ বা মলদ্বার থেকে তীব্র রক্তপাত হয়। নারীদের অসময়ে ঋতুস্রাব অথবা রক্তক্ষরণ শুরু হয়।
- অতিরিক্ত দুর্বলতা, অবসাদ কিংবা অস্থিরতা দেখা দেয়।
- রক্তে অণুচক্রিকার পরিমাণ দ্রুত কমে যায় এবং হেমাটোক্রিট দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
- নাড়ির স্পন্দন অত্যন্ত ক্ষীণ ও দ্রুত হয় এবং শরীরের হাত-পা ও অন্যান্য অংশ ঠান্ডা হয়ে যায়।
- অনেক সময় রোগীর লিভার আক্রান্ত হয়ে জন্ডিস ও কিডনির রেনাল ফেইলিউর নামক জটিলতা দেখা দিতে পারে।
ডেঙ্গু শক সিনড্রোম
ডেঙ্গুর ভয়াভহ রূপ হলো ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। এটি খুব জটিল একটি পর্যায়। ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বরের সঙ্গে সার্কুলেটরি ফেইলিউর হয়ে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হয়। এর লক্ষণ হলো :
- বেরিয়ে যাওয়া তরল রক্তপ্রবাহে ফেরত আসে। দুই থেকে তিনদিন স্থায়ী হয়।
- রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়।
- প্রচন্ড চুলকানি এবং হৃদস্পন্দনের গতি ধীর হয়ে যায়।
- ত্বকে গুটি বেরোয়।
- মস্তিষ্ক আক্রান্ত হয়ে সচেতনতার মাত্রা হ্রাস অথবা মুর্ছা যায়। এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে মৃত্যু পর্যন্ত হয়।
রোগীর এ ধরণের কোনো লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালে নিতে হবে। তবে যাদের আগেই ডেঙ্গু ভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছে তাদের অবস্থা আরো বেশি অবনতি হতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বরের প্রতিকার
ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুর রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। সাধারণত ৫ থেকে ১০ দিনের মধ্যে নিজে নিজেই ভালো হয়ে যান। এমনকি কোনো চিকিৎসা না করালেও। তবে রোগীকে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চলতে হবে। কারণ অবস্থার জটিলতাও তৈরী হতে পারে। তাই প্রাইমারি কেয়ার সেন্টার বা আপনার নিয়মিত চিকিৎসকের চেম্বারে নিয়ে গেলেই চলবে। তারপরে ডাক্তার আপনাকে পরামর্শ দেবে কি করতে হবে। তবে অবশ্যই সম্পূর্ণ ভালো না হওয়া পর্যন্ত পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে। গায়ে ব্যথার জন্য অ্যাসপিরিনজাতীয় ওষুধ খাওয়া যাবে না। ডেঙ্গুর সময় অ্যাসপিরিনের মতো ওষুধ সেবন করলে রক্তক্ষরণ হতে পারে।
হেমোরেজিক জ্বর রোগীর জটিল অবস্থা সৃষ্টি করে। এই জন্য রোগীকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ঠিকমতো চিকিৎসা করাতে হবে। ডেংগুতে প্লেইটলেট শরীরে দেওয়া লাগবে কিনা তা ডাক্তারকেই সিদ্ধান্ত নিতে দিন।
ডেংগু শক সিন্ড্রোম পর্যায়ে রোগীকে অবশ্যই আইসিইউতে নিয়ে যেতে হবে। এ অবস্থায় রোগের লিভার, কিডনি,হার্ট, লাংস সব দিকেই সমস্যা হতে পারে। সব কিছু পরীক্ষা করে মনিটর করতে হয়। হিসেব করে শিরায় ফ্লুইড দিতে হয়৷ তবে মনে রাখবেন জ্বর কমে যাওয়ার পরই মূলত ক্রিটিক্যাল ফেইজ শুরু হয়। তাই জ্বর কমলেই ভাল হয়ে গেল এটা ভেবে চিকিৎসা নেওয়া বন্ধ করবেন না।
ডেঙ্গু রোগীকে যেসব খাবার খাওয়াতে হবে
ডেঙ্গু জ্বরে শরীর অনেক দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই রোগীকে পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে। ডেঙ্গু জ্বর হলে অবশ্যই আপনাকে খাবারের প্রতি বিশেষভাবে মনযোগী হতে হবে। বেশি বেশি তরল খাবার খেতে হবে। যাতে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় কিন্তু সব খাবার আবার দেহের জন্য উপযোগী নয়। তাই রোগীকে যে সকল খাবার খাওয়াতে হবে তা হলঃ
- কমলাঃ কমলার রস ডেঙ্গু জ্বরে ভালো কাজে আসে। কারণ এটিতে রয়েছে ভিটামিন সি এবং অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। আর এই দুটি উপাদান ডেঙ্গু জ্বর নিয়ন্ত্রণে উপকার করে।
- ডাবের পানিঃ ডেঙ্গু রোগীর পানিশূন্যতা দেখা দেয়। এই জন্য ডাবের পানি অনেক উপকারী। এতে থাকে ইলেক্ট্রোলাইটসের মতো প্রয়োজনীয় পুষ্টি।
- ডালিমঃ ডালিমে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও মিনারেল। প্রাচীন কাল থেকে এই ফলটি পুষ্টির ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি ডেঙ্গু জ্বরে রোগীর যে ক্লান্তি অবসাদ তৈরী করে সেটা দূর করে দেয়।
- মেথিঃ মেথি খেলে ডেঙ্গু জ্বরে আপনি অতি সহজে ঘুমিয়ে যেতে পারবেন। এর সাথে এটি আপনার অতিরিক্তমাত্রার জ্বর কমিয়ে আনতে সহয়তা করবে। তবে মেথি গ্রহণ করার পূর্বে অবশ্যই চিকিৎসকের পরমার্শ নিবেন।
- হলুদঃ ডেঙ্গু জ্বর হলে এক গ্লাস দুধের সঙ্গে এক চিমটি হলুদ মিশিয়ে পান করুন। এতে আপনাকে অতি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন।
- ব্রোকোলিঃ ব্রুকলিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন কে, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং খনিজ সমৃদ্ধ। ব্রুকলি রক্তের প্লেটলেট বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। তাই ডেঙ্গু জ্বর হলে এটি বেশি বেশি খাবেন।
ডেঙ্গু রোগী কী কী খাবার খেতে পারবেন না
- তৈলাক্ত ও ভাজা এবং মশলাযুক্ত খাবারঃ ডেঙ্গু হলে তৈলাক্ত ও ভাজাপোড়া খাবার পরিহার করুন। এতে আপনার দেহের আরও বেশি ক্ষতি হবে।ডেঙ্গুর রোগীকে অবশ্যই মসলাযুক্ত খাবার পরিহার করতে হবে নতুবা পাকস্থলীর দেয়াল ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
- ক্যাফেইন যুক্ত পানীয়ঃ ডেঙ্গু হলে ক্যাফিন যুক্ত পানীয় পান করা যাবে না। এগুলো আপনার হার্ট রেট বাড়িয়ে দেবে। রক্তচাপের সমস্যা তৈরি করবে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে যা করবেন
ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি স্ট্রেইন (ডেন-১, ২, ৩ ও ডেন-৪)। তাই ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে সবাইকে সচেতন হতে হবে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে যা করবেনঃ
- এডিস মশা শুধুমাত্র পরিষ্কার পানিতে বংশবিস্তার করে থাকে। তাই ফুলের টব, অব্যবহৃত টায়ার, মাটি বা প্লাস্টিকের পাত্র ও ফুলদানিতে কয়েকদিনের বাসি পানি যেন না জমে থাকে সেই দিকে খেয়াল রাখুন। বাড়ির আশেপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন।
- যেহেতু এডিস মশা দিনের বেলা বেশি কামড়ায় সেহেতু দিনের বেলা ঘুমালে মশারি টানিয়ে ঘুমাবেন। শিশুদের ফুলহাতা জামা ও ফুলপ্যান্ট পরাবেন।
- বাথরুমে যদি পানি ধরে রাখতে হয় তাহলে পানির পাত্র সপ্তাহে অন্তত একবার ব্লিচিং পাউডার দিয়ে ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার করবেন।
সচেতনতা থাকলেই এডিস মশার বংশবিস্তার রোধ হয়ে যাবে। যেহেতু বর্ষার সময় এডিস মশার উপদ্রব বেড়ে যায় সেহেতু এই সময়ে আরো বেশি সচেতন হতে হবে। মনে রাখবেন নিজের নিরাপত্তা নিজের কাছে। তাই পরিবার এবং বন্ধুবান্ধবকে ডেঙ্গুজ্বর সম্বন্ধে জানাতে এবং সচেতন করতে আর্টিকেলটি আপনি শেয়ার করতে পারেন।