ধরুন, আপনি এমন কিছু দেখতে পাচ্ছেন যেটির বাস্তবে কোন অস্তিত্ব নেই। অথচ আপনি ঠিকই আপনার চোখের সামনে সেটি দেখতে পাচ্ছেন। নাহ, ভূতের গল্প বলছিনা কিন্তু। যদি আপনি ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কি সে সম্পর্কে কিছুটা হলেও জেনে থাকেন, তাহলে বুঝতে পারবেন এ দারুণ প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে যেটি বাস্তব নয় সেটিও চোখের সামনে নিয়ে আসা সম্ভব।
সত্যি বলতে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি তথ্যপ্রযুক্তির এমন এক আবিষ্কার, যেটি অবাক করে দিয়েছে গোটা বিশ্ববাসীকে। বিশেষ করে যারা টেকনোলজির আপডেট সম্পর্কে ধারণা রাখেন, তারা কিন্তু একবার হলেও এই ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে সময় কাটানোর অভিজ্ঞতা পেতে চান। এই ভার্চুয়াল রিয়েলিটির সুবিধা সুবিধা অসুবিধা দুটোই রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
আজকের লেখায় আমি ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কি, এটির উপাদান এবং ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে আলোচনা করবো। পাশাপাশি আপনারা জানতে পারবেন ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ইতিহাস এবং বৈশিষ্ট্য। আমি চেষ্টা করবো খুব সহজ ভাষায় ভার্চুয়াল রিয়েলিটি সম্পর্কে বিভিন্ন ইন্টারেস্টিং তথ্য তুলে ধরতে যাতে করে সবার বুঝতে সুবিধা হয়। তাই পুরো লেখাটি ধৈর্য্য সহকারে পড়ে দেখুন।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কি?
যারা ভার্চুয়াল রিয়েলিটি শব্দটি নতুন শুনলেন, তারা নিশ্চয়ই সবার শুরুতেই জানতে চাইবেন ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কি। এ প্রশ্নটির উত্তর দেয়ার আগে একটি ছোট্ট উদাহরণ দেই।
ছোটবেলা থেকে মঙ্গল গ্রহের নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন? ধরা যাক আপনার মঙ্গল গ্রহের মাটিতে হেঁটে বেড়ানোর অনেক শখ। অথবা, আপনার ইচ্ছা কোন এক গহীন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ঘুরে বেড়াবেন ও দেখবেন নানান ধরণের বিচিত্র প্রাণী। এখন চাইলেই আপনি সশরীরে মঙ্গল গ্রহের মাটিতে অথবা গভীর জঙ্গলে চলে যেতে না পারলেও ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কাজে লাগিয়ে আপনার এই ইচ্ছাগুলো পূরণ করা সম্ভব।
কারণ ভার্চুয়াল রিয়েলিটি হলো কম্পিউটারের মাধ্যমে পরিচালিত এমন এক প্রযুক্তি, যেটির মাধ্যমে একজন মানুষ সম্পূর্ণ কৃত্রিমভাবে তৈরি পরিবেশের থেকেও বাস্তবের পরিবেশের মতো অনুভূতি পেতে সক্ষম৷ অর্থাৎ ,আপনি মঙ্গল গ্রহে থাকবেন না ঠিকই। কিন্তু ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে আপনার মনে হবে আপনি মঙ্গল গ্রহেই রয়েছেন। শুধু তাই নয়,আপনার মনে হবে আপনি সেখানকার পরিবেশ নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছেন, সেই গ্রহের শব্দ শুনতে পাচ্ছেন, এমনকি গ্রহের বিভিন্ন উপাদান স্পর্শও করতে পারছেন।
আশা করি ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কি সে সম্পর্কে আপনাদের কিছুটা হলেও ধারনা দিতে পেরেছি। আরেকটু বিস্তারিত ভাবে যদি বলি, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি হলো উন্নত প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে মানুষের কল্পনার বিভিন্ন দৃশ্যকে কৃত্রিমভাবে কম্পিউটারের মাধ্যমে বাস্তবে রূপ দেয়ার একটি প্রচেষ্টা। একারণে যখন একজন মানুষ ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে থাকেন, তখন তিনি বুঝতে পারেন না যে তিনি কৃত্রিমভাবে তৈরি করা একটি পরিবেশে বিচরণ করছেন। বরং তিনি ভাবেন তার সেখানে দেখা ও অনুভব করা প্রতিটি দৃশ্যই সত্য।
এর কারণ কি জানেন? এর কারণ হলো ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে টু-ডি নয়, বরং থ্রি-ডি, এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে ফাইভ-ডি প্রযুক্তির সাহায্যে বিভিন্ন কৃত্রিম দৃশ্য, যেমনঃ মঙ্গল গ্রহের পরিবেশ, আমাজন জঙ্গল অথবা গভীর সমুদ্র তৈরি করা হয়।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটির উপাদান কি কি?
ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কি সে সম্পর্কে জানার পর স্বাভাবিকভাবেই আপনাদের আগ্রহ জাগবে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির উপাদান কি কি তা জানার জন্য। যেহেতু ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে কম্পিউটারের প্রযুক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন কৃত্রিম পরিবেশ তৈরি করা হয়, তাই ভার্চুয়াল রিয়েলিটির অন্যতম উপাদান হলো বিভিন্ন ধরনের আধুনিক ডিভাইস, যেমনঃ ডেটা গ্লোভ, হেড মাউন্টেড ডিসপ্লে, গ্রাফিকস ও মডেলিংয়ের সফটওয়্যার, হাই কোয়ালিটি অডিও সিস্টেম, বিভিন্ন সেন্সর, রিয়েলিটি ইঞ্জিন, কমপ্লিট বডি স্যুইট, সিমুলেশন ইত্যাদি।
এগুলো হল ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মূল কিছু উপাদান। এছাড়াও ভার্চুয়াল রিয়েলিটির উপাদান কি কি সে সম্পর্কে বলতে গেলে আরো কয়েকটি উপাদানের নাম চলে আসে। যেমনঃ জিওমেট্রি হলো ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে যে কৃত্রিম পরিবেশ রয়েছে সে পরিবেশের বিভিন্ন বস্তুর বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যের বিস্তারিত ইনফরমেশন।
আবার ইফেক্টর নামক একটি ডিভাইস কে কাজে লাগিয়ে একজন মানুষ চাইলে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি যে কৃত্রিম পরিবেশ তৈরী করে সে পরিবেশে প্রবেশ করতে পারেন। ইফেক্টর নামক ডিভাইসটিকে আর একটু ভালোমতো কাজ করতে সাহায্য করে রিয়েলিটি সিমুলেটর। রিয়ালিটি সিমুলেটর এর কাজ ইফেক্টরের কাছে বিভিন্ন সংবেদনশীল তথ্য সেন্ড করা।
এছাড়াও ভার্চুয়াল রিয়েলিটি এপ্লিকেশন নামক আরেকটি উপাদান রয়েছে যেটির মাধ্যমে কেউ ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে প্রবেশ করার পর বাস্তব জগতের মতোই অনুভূতি পান।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটির বৈশিষ্ট্য কি?
ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কি এবং ভার্চুয়াল রিয়েলিটির উপাদান কি কি জানানোর পর এখন আমি আপনাদেরকে জানাবো ভার্চুয়াল রিয়েলিটির বৈশিষ্ট্য কি কি সে সম্পর্কে। ভার্চুয়াল রিয়েলিটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এটি কম্পিউটারের মাধ্যমে থ্রিডি ছবির সাহায্যে তৈরি করা হয়।
আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো যিনি ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে প্রবেশ করেন তার গতিবিধি অনুযায়ী এ থ্রিডি ছবিগুলো পরিবর্তিত হতে থাকে। কেউ যদি ভার্চুয়াল রিয়েলিটির অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চান, তাকে বিশেষ এক ধরনের গ্লাস বা হেলমেট পড়তে দেয়া হয়। এই হেলমেট বা গ্লাস পরার পরে একজন মানুষ এই রিয়ালিটির এক্সপেরিয়েন্স নিতে পারেন।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটির বৈশিষ্ট্য হিসেবে আরও বলা যায় ভার্চুয়াল রিয়েলিটি মূলত ৫ ধরণের।
Fully Immersive ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে আপনি ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে যা দেখবেন ও শুনবেন, সেটিকে সম্পূর্ণভাবে বাস্তবের মতো মনে হয়।
Non Immersive নামক ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে আপনি ভার্চুয়াল রিয়েলিটির সবকিছু দেখতে পাবেন ঠিকই কিন্তু আপনি সরাসরি সেই জগতের যে এনভায়রনমেন্ট, সেটির সাথে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকবেন।
Semi Immersive ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে কম্পিউটার স্ক্রিন, ভিআর বক্স অথবা হেডসেটকে কাজে লাগিয়ে কম্পিউটারের মাউস ব্যবহার করে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির এক্সপেরিয়েন্স নিতে পারবেন।
Augmented Virtual Reality এর মাধ্যমে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির যে বিশেষ পরিবেশ রয়েছে সেটি তৈরি করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ এই ভার্চুয়াল রিয়েলিটি আসল জগতের সাথে ভার্চুয়াল জগতের একটি কানেকশন তৈরি করে থাকে।
Collaborative Virtual Reality তে একই সাথে অনেক জন ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে প্রবেশ করতে পারেন এবং নিজেদের মধ্যে কমিউনিকেশন করতে পারেন হেডসেট অথবা মাইক্রোফোন ব্যবহার করে। এই ধরনের ভার্চুয়াল রিয়েলিটির প্রয়োগ আমরা দেখতে পাই এখনকার সময়ের সবার পছন্দের পাবজি এবং ফ্রী ফায়ার গেম এর মধ্যে।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ইতিহাস | ভার্চুয়াল রিয়েলিটির জনক কে?
লেখার এই অংশে আমি আপনাদেরকে জানাবো ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ইতিহাস, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কত সালে আবিষ্কার হয় এবং ভার্চুয়াল রিয়েলিটির জনক কে এ দুটি বিষয় সম্পর্কে। ভার্চুয়াল রিয়েলিটির জনকের নাম মর্টন হেলিগ যার হাত ধরেই ১৯৫৭ সালের দিকে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি আবিষ্কার হয়। এরপর ১৯৮০ এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ব্যবহার শুরু করা হয়েছিলো। তারপর থেকেই উন্নত হতে হতে আজকের এই ভার্চুয়াল রিয়েলিটি সৃষ্টি হয়েছে।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটির সুবিধা অসুবিধা
যারা ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কি সে সম্পর্কে নতুন জেনেছেন, তারা তারা সব সময় ভার্চুয়াল রিয়েলিটির সুবিধা অসুবিধা সম্পর্কে জানতে চান। সত্যি বলতে প্রতিটি জিনিসের সুবিধা এবং অসুবিধা এ দুটি থাকে। কারণ ভালো-খারাপ একটি আরেকটির পরিপূরক। তাই ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব বিদ্যমান রয়েছে।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটির সুবিধা
ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মূল সুবিধার একটি হচ্ছে এই রিয়ালিটির মাধ্যমে যেকোনো কঠিন বিষয় কেউ সহজ ভাবে সবার সামনে উপস্থাপন করা যায়।
তাই, যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা ট্রেনিংয়ের বিভিন্ন জটিল বিষয়কে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি দিয়ে সহজ করে তোলা যায়। এ কারণেই অনেক জায়গায় এখন যেসব প্রশিক্ষণ কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ, সেখানে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির প্রয়োগ দেখা যায়।
শুধু তাই নয়, বর্তমানে কোনো একটি প্রজেক্ট কিংবা কোনো কাজ করার আগে সেই কাজটির সফলতা আসতে পারে কিনা, সে বিষয়ে নিরীক্ষণের জন্য ভার্চুয়াল রিয়েলিটির সাহায্য নেয়া হয়। একারণে উৎপাদন এবং গবেষণা ক্ষেত্রে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি আশীর্বাদস্বরূপ।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটির অসুবিধা
এবার আসা যাক ভার্চুয়াল রিয়েলিটির অসুবিধা নিয়ে। ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মূল অসুবিধা হলো এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তাই সবার পক্ষে এই রিয়েলিটি অভিজ্ঞতা নেয়া সম্ভব হয় না। একই সাথে প্রয়োজনীয় সব ক্ষেত্রে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির প্রয়োগ করাও সম্ভব হয় না।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটির আরেকটি অসুবিধা হলো স্বাস্থ্যের ক্ষতি। গবেষকরা বলেছেন দীর্ঘসময় ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে অবস্থান করলে এটি চোখের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। বিশেষ করে যারা পাবজি অথবা ফ্রী ফায়ার এর মতন গেমগুলোতে আসক্ত, তারা চোখের সমস্যা, মাথা ব্যথা, পিঠে ব্যথা ইত্যাদি বিভিন্ন অসুবিধায় ভুগে থাকেন।
এগুলোর সাথে সাথে ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে অবস্থান করার ফলে অনেক সময় মানুষের বাস্তব জগৎ আর সেভাবে ভালো লাগেনা। কারণ তখন সেই কৃত্রিম জগতকে বেশি ভালো মনে হয়।
সুতরাং আপনারা বুঝতেই পারছেন ভার্চুয়াল রিয়েলিটির সুবিধা অসুবিধা দুটিই রয়েছে। আমরা আমাদের আজকের আর্টিকেলের প্রায় শেষের অংশ চলে এসেছি। আশা করি সহজ ভাষায় লেখা আর্টিকেলটি পড়ার পর ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কি এবং এ সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে আপনারা জানতে পেরেছেন। যদি এই লেখাটি ভালো লাগে, তাহলে সবার সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না